Sunday, 5 April 2020

শহীদ সেলিনা পারভীন কিংবা আমাদের মনি আপা -নাজমুস শাহাদাত


গ্রামের একটা স্কুলে শিক্ষকতা করি। পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা পড়াই।পড়াচ্ছিলাম লেখক শফিউল আলমের লেখা- "আমরা তোমাদের ভুলবো না।"
সমস্ত শ্রেনী কক্ষ সুনসান নীরব । গমগম কন্ঠে আদর্শ পাঠ দিচ্ছিলাম। শিশুরাও সেই মহান ব্যক্তিদের কথা কান পেতে টানটান হয়ে শুনছে।

জেদি অন্যায়ের প্রতি আপসহীন এক লৌহমানবীর ছবি।
আমাকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকতে দেখে শিশুরা আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। ছবিটি দেখিয়ে বললাম, এ আমার বোনের ছবি। আমার বড় ফুফুর মেয়ে। ওরা অবাক হয়ে অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকাল।
বললাম, 'শোন তারা তো কারো না কারো বোন,মা,ভাই,বাবা।'
স্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে গেলাম। সেই বহুদিন আগে কি যেন একটা কাজে তার ছেলে সুমনকে নিয়ে মামা, মানে আমার আব্বার কাছে এসেছিলেন ।
আমরা তখন সোনাপুর। আব্বা থানা পশুপালন কর্মকর্তা । সুমন ছিলো শুকনো তালপাতার সেপাই। আমাদেরই বয়সী। তবে মনি আপা সারাক্ষণই ওকে নিয়মনীতির ভেতর বেধে রাখতেন। অল্প ক'দিনের জন্য এসেও ওকে পড়াতে বসতেন। নিজ হাতে খাইয়ে দিতেন, গোসল করাতেন, মাঝে মধ্যে দেখতাম গানও শেখাতেন।
কত ছোট ছিলাম, তারপরও মনে আছে তার কি সুশৃঙ্খল জীবন চলা। কি স্মার্ট, মুখে গাম্ভীর্যের প্রলেপ, কিন্তু মুখখানা হাসি হাসি। জর্জেট শাড়ি পরতেন সবসময়।
মনি আপা স্পষ্টবাদী, অন্যায়ের তীব্র প্রতিবাদ করতেন। কিন্তু এ লৌহমানবীর ভেতরে ছিল এক কোমল মমতার ঝরনা।

একদিন আমাদের বাসায় কড়া নাড়ছিলো এক ভিখারিনী। কোলে ছোট একটা বাচ্চা। মা মেয়েটাকে চিনতেন,তাই ধমকে উঠলেন। বাচ্চাটা অবৈধ, তাই কেউ তেমন সাহায্য করত না। বরং দেখলেই ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নিত।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে মনি আপা মেয়েটাকে ব্যাগ থেকে কিছু টাকা দিলেন ও মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মেয়েটার গমন পথের দিকে চেয়ে বললেন, "পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়।'' আব্বা শুনে বললেন, 'এসব কারণে তোকে কেউ দেখতে পারে না।'
তিনি হাসলেন । সে হাসি নিপীড়িত জনতার জন্য ভালোবাসার নিষ্পাপ হাসি।
মনি আপা চলে গেলেন সুমনকে নিয়ে ঢাকায় ।
আর তার সঙ্গে দেখা হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আমরা সোনাপুর থেকে গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিই। ঢাকা থেকে মনি আপার ছোট বোন কুটু বুবু, তার ছেলে নান্নু, মেয়ে কঙ্কা আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তার ছোট ভাই খোকন দাদা, বউ, শালী রুহী তারাও ফেনী থেকে আসে । ফুফু আম্মা, মনি আপা বা সুমন আসেনি ।
যুদ্ধ শেষ হলে সবাই যে যার আবাসস্থলে ফিরে যায়। দেশ স্বাধীন হলে আমরা খবর পাই, মনি আপাকে এক গাড়ি আর্মি এসে বাসা থেকে নিয়ে যায়।
তিনি তখন রান্না করছিলেন। হাতে গামছা ছিলো, তা দিয়ে চোখ বেঁধে গাড়িতে তোলে। তাকে ঘাতকের দল নৃশংস ভাবে হত্যা করে । বুদ্ধিজীবী নিধনের নীল নকশার তালিকায় তার নাম ছিল।
১৯৭২ সালে আমার একটা বোন হয়। আমরা মনি আপার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার নাম রাখি সেলিনা পারভীন ।
মনি আপার এরকম করুন মৃত্যুতে ফুফু খুবই ভেঙে পড়েন। এ সময় সুমন ওর বাচ্চু মামার বাসায় থাকত। আব্বা গিয়ে ফুফুকে সোনাপুর নিয়ে আসেন । ফুফুর কাছে আমরা মনি আপা ও সুমনের অনেক খবর পাই।
তিনি আসার সময় মনি আপার কিছু জর্জেট শাড়ি নিয়ে আসেন, যা আমরা শুঁকে বলতাম, "মনি আপার গন্ধ ।"
এত বছর পর আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। গর্বে বুকটা ফুলে উঠল। শ্রদ্ধায় মাথাটা নত হয়ে এলো। মনের অজান্তেই বললাম, "এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলবো না।"
উপলব্ধি করলাম, এ দেশের জন্য জীবন দিয়ে যারা শহীদ হয়েছেন, আর বেঁচে গাজি হয়ে ফিরে এসেছেন তারা আকাশের চেয়েও সীমাহীন সম্মানের অধিকারী। যারা তাদের হত্যা করেছে, হত্যায় সহযোগিতা করেছে তারাই অভিশপ্ত, ঘৃণিত ।

No comments:

Post a Comment

মাতাল নদীর রোদ ও পিংক ফ্লয়েড

এক লোক ট্রল করে ফেবু তে এই লোকের গাওয়া পিংক ফ্লয়েডের উইশ ইউ আর হিয়ার এর বাংলা ভার্শান দিলো ।  বাট আমার গান টা অসম্ভব ভালো লাগে । এক ধরণের ঘো...