মধ্যবিত্ত পরিবারে সব কিছু হিসেব করে খরচ করার নিয়মের মধ্যে দেখলাম আম্মা আব্বা কলম খরচ করার ব্যাপার টা তে শুধু যে খুশি হন, তা কিন্তু না। পাশাপাশি পিঠে কয়েকটা সাবাশমূলক ধুম ধাম চাপড় ও মারেন। কলমের কালির ঘ্রাণ পছন্দের কারনেই হয়ত বা বন্ধুদের পচানোর খোরাক গল্প কবিতা লেখা শুরু করে দিয়েছি।
কলমের কালির ঘ্রাণ এখন আর পাই না,যদিও কী - বোর্ড টা ও কালো। বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ইংরেজি তে লিখতে হয়। কেন জানি আমার ইংরেজি কোন নোভেল পড়তেও ভালো লাগেনা,বাংলার মত কন্টিনিউয়াস ইংরেজি বর্ণ গুলো লিখতেও পারিনা। ( টং দোকানে মোবাইলে অভ্র কি বোর্ডে বাংলা লেখার কম্পিটিশান এ চ্যাম্পিয়ন :3) কিন্তু এখনও একটা গন্ধের জন্য মস্তিষ্কে অনেক খানি আবেগ বরাদ্দ দেওয়া। তা হল যেকোন বাংলা বই এর গন্ধ।
একদম চরম সত্য হচ্ছে, পিডিএফ এর সহজলভ্যতায় আর মানিব্যাগের ভার কম থাকায় বিভিন্ন কোর্স এর বই কেনা হত না, আবার আগে আগে কোর্স করে ফেলা বন্ধু বান্ধব থেকে আনা বই গুলাও সেভাবে আবেদন জাগাতে পারেনাই মনে।
স্কুল লাইফ থেকেই নিউমার্কেট আর নীলক্ষেত সম্পর্কে নানান মিথ ছিল মনের ভেতরে। মধ্যবিত্তের জীবনে সমাজে মানিয়ে চলতে হয় নানার রেপ্লিকায় আবদ্ধ হয়ে একটা হাসির রেপ্লিকা মুখে নিয়ে। জামা কাপড়ের জন্য ভেনার প্লাজা ( ভ্যান গাড়ি) কিংবা নিউমার্কেট এ যেতে হতই। তখন আস্তে আস্তে নীলক্ষেতের সাথে পরিচয়। তখন একদিন একটা বই এর দাম জিজ্ঞেস করলাম হুদাই। গায়ের দাম ই ছিল ৮৫০ এর মত। সেটা কমিয়ে বললেও বলবে হয়ত চার পাচ শ। ওমা,ওই বই আমাকে ১৫০ এ দিয়ে দিল। আবার অনেক জোরাজুরি করে ১০ টাকা ভাড়াও নিতে পারলাম।
সেই থেকে নীলক্ষেত আমার জন্য এক আবেদনের বস্তু। সব সময় যাই পুরান বই কিনতে,পুরান বই এর ঘ্রাণ নিতে। অনেক প্রবীণ একটা মায়াবী ঘ্রাণ সে ঘ্রাণ। মাহাতাব ভাই একটা কথা বলেন প্রায়ই, "নীলক্ষেতে গেলে একই সাথে অনেক আনন্দ হয়। কারণ চারপাশে এত বই,সব সাধ্যের মধ্যে। আবার অনেক হতাশ ও লাগে,এত বই একজীবনে কখন পড়ে শেষ করবো?! "
পুরান বই এর ঘ্রাণ এর থেকেও আরো ভেলিড আলোচনা হল নতুন বই এর ঘ্রাণ। সব সময় নতুন ক্লাসের প্রথম দিন ত সে জন্যেই জাওয়া। এখন তো আর বই কিনিনা নতুন কোর্সে উঠে।এখন?
এখন বছরের প্রথম মাসের বদলে দ্বিতীয় মাসে যাই বইমেলায়। চারপাশে কত শত বই। প্রথমেই যাই মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের স্টলে। নতুন কোন পোস্টার থাকলে সাথে সাথে কিনে ফেলি, পুরানো পোস্টার হল্ব কিনি , নোয়াখালীর বাসার জন্য। কয়দিন আগে মেস চেঞ্জ করার পর কয়েকটা পোস্টার লাপাত্তা। আজ গিয়ে সেগুলো কিনলাম। সাথে নতুন তিনটা ইমেজ কার্ড । এবার গিয়ে এক দূর্দান্ত জিনিস পেয়ে গেলাম। জহির রায়হানের "স্টপ জেনোসাইড" আর কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এর সিডি। সাথগে সাথেই কিনে ফেললাম। এর পর আবার বই মেলায় হারিয়ে যাই। একবার এদিক ছুটি তো আরেকবার ওদিক। বই এর নাম পড়ি, ঘ্রাণ নি। কিন্তু পকেটের দিকে তাকিয়ে আবার ২০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে আবার চলে আসি নীলক্ষেত।রিকশায় করে আসি,যেন তাড়াতাড়ি বই মেলা থেকে বই কিনতে না পারার আপেক্ষ টা চলে যায়।
নীলক্ষেত এসেই তো দেখি সব পুরান পুরান বই নিয়ে বসে আছেন লোক জন রাস্তার ধারে। যা নেন, সব ১০০. তাড়াতাড়ি করে এই বই নি,ওই বই হাতে নিয়ে নি। কিনবো নাকি না কিনবো তা পরের,আগে দখল করি। সীমিত সংখ্যক বই। এর পর হাত খরচের টাকা থেকে টুক টাক বিলাসিতার খরচ বাদ দিয়ে তার সমানুপাতে বই হাতে ধরে রাখি আর ঘ্রাণ নিই। পুরান বই এর ঘ্রাণ। মনে মনে বাজতে থাকে "কি করি আজ ভেবে না পাই,পথ হারিয়ে কোন বনে যাই....."
একটা ক্যাটস-আই এর শার্টের রেপ্লিকা হয়,একটা নাইকি বা এডিড্যাসের জুতার রেপ্লিকা হয়,লোটোর রেপ্লিকা জুতা কিনলাম ১২০ টাকা দিয়ে,ক্যাসিও ক্যালকুলেটর এর রেপ্লিকা হয়। রেপ্লিকাতেই চলে হরপদমসে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল,এই যে বই, কম দামে পাচ্ছি, এগুলা কিন্তু রেপ্লিকা না। অনেক বছর আগে নজরুল, রবীন্দ্র, শরত কিংবা সত্যজিত যা লিখে গিয়েছিলেন,তা ই আমি পড়তে পারছি। ঘ্রাণে কিই বা আসে যায়। আমার কাছে যেমন আমার ছোট ভাই এর গায়ের ঘ্রাণ অনেক প্রিয়,তেমনি আমার বাবার, দাদার নানার গায়ের ঘ্রাণ ও অনেক প্রিয়।
রিফাত আহাম্মেদ, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৯
No comments:
Post a Comment