Sunday, 5 April 2020

উপকূল এক্সপ্রেস, ময়লা গেঞ্জি এবং আমি


আমি অনেক জেলা , অনেক জায়গা ঘুরেছি , মিশেছি অনেক লোকের সাথে। তবুও শ্রেণীভেদে মানুষের সাথে মানুষের জীবন অনেক জটিল এক অঙ্ক। এই অঙ্ক কষা কিন্তু সহজ কথা নয়। এত বেলা কেটে গেলো , অথচ কিছুই মিলেনি এই হিসাবের । একবার সেমিস্টার ব্রেকে চিন্তা করলাম , দিন মজুর দের সাথে সারাটা পথ একসাথে যাবো। ট্রেনে উঠার পাদানি কিংবা ট্রেনের ইঞ্জিনে করে এর আগে অনেক বার ঘুরেছি অনেক জায়গায়। হয়ত আমার বা আমাদের কাছে এটা সচরাচর না এবং খুবই রোমাঞ্চকর, কিন্তু যাদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশই এই অস্বাভাবিকতা, তাদের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে পুরো প্রেক্ষাপট টা দেখতে কি আমাদের চোখে লাগা উদ্দাম তারুণ্যের আলোর মতই রঙ্গিন ? নাকি এই অধ্যায় অনেক চাপা কষ্টের ম্লান আর্তনাদের নিশ্চুপ কোলাহল।

কেমন করেই বা তাদের সাথে অজানা পথিকের চোখাচোখি হয় , অথবা স্বাভাবিকতার বলয় থেকে বেরিয়ে কি তাদের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিবাণ নিক্ষেপ করে সবাই ?

উঠে গেলাম এয়ারপোর্ট স্টেশান থেকে উপকূল এক্সপ্রেস এ, একটা ময়লা ছেঁড়া গেঞ্জি পরে । কিছুদুর যেতেই দেখলাম  একটা ছেলে গান গাইছে একটা থালার মত জিনিস পেটাতে পেটাতে। ছেলেটা অসম্ভব সুন্দর গাইছিলো, আর তবলা মত থালা পেটাচ্ছিলো। কিন্তু সবাই তার দিকে এক করূনার দৃষ্টি নিয়ে বদ্ধ ট্রেনে তাকিয়ে ছিল তার অন্ধ ঝাপসা চোখ দুটোর দিকে। আপি তার পিছু নিলাম । তার গান শুনতে শুনতে তিন বগি পার হলাম মানুষের ভিড় এড়িয়ে। কিন্তু তার মত এত সূক্ষ্ণভাবে এই ভিড়ের মাঝে হনহন করে হাটতে পারলাম না ।তার গান ও আস্তে আস্তে মিলিয়ে এলো।

এর পর গিয়ে বসলাম দড়জার কাছে বস্তানিয়ে বসা কয়েকজন দিনমজুর ভাই দের সাথে। বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন জিনিস সাঁই করে চলে যায় , আর তা নিয়ে বিচ্ছিন্ন কিছু মন্তব্য করেও আলোচনা জমলো না। তাই বাধ্য হয়ে তাদের সাথে চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম এক দৃষ্টিতে। প্রথমে বিরক্তি লাগলেও পরমুহূর্তেই ট্রেনের চাকার তালের সাথে সকল কিছুর পেছনে ছুটে যাওয়ার একটা অন্তমিল উপভোগ করতে লাগলাম ।

এর পর বিভিন্ন স্টেশানে তারাও সবাই নেমে গেলেন। রইলেন বাকি একজন । সরল মনে জিজ্ঞেস করলাম কই যাবেন ? আঁতকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষন । বুঝলাম গড়মিল হয়ে গিয়েছে কোথাও। কোথায় হয়েছে ? ও হ্যাঁ, আমার লেবাসের সাথে প্রমিত ভাষার কথা মেবি তালগোল পাকিয়ে ফেলছিল। বলল নোয়াখালী ।বুঝলাম একদম শেষ স্টেশান পর্যন্ত তাহলে কথা বার্তা বলার মত একজন ভাই কে পাওয়া গেলো । এইবেলা আমার ছুড়ে দেওয়া নানার কথার জবাব দিচ্ছেন তিনিও।

অনেক পরে রাতের দিকে দেখলাম ট্রেনের ঝিক ঝিক আওয়াজ ভেদ করে বগির ভেতর থেকে মানুষের আওয়াজ আসছে। দেখলাম সবাই খুব ভয়ে ভয়ে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের চাঁদা দিচ্ছে। একে একে সবার কাছ থেকে নিল। এর পর বগি পার হওয়ার সময় আমাদের দিকে তাকালো । আমরা ট্রেনের দড়জায় পাদানিতে বসে মাথা ঘুরে তাদের কান্ডকারখানা দেখছিলাম আর দেখতে চাইলাম আমার সাথের এই লোক কিভাবে ওদের জবাব দেয় । কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে ওরা আমাদের থেকে টাকা না নিয়েই চলে গেলো।

জিজ্ঞেস করলাম ,' আমাদের থেকে টাকা নিলোনা কেন ?"
মুচকি হেসে ওই লোক জবাব দিলেন তারাও চেহারা দেখে বুঝে কার কাছে টাকা আছে আর কার কাছে নাই। তার এই জবাব শুনে বুঝলাম তাদের এই জাজমেন্ট পুরোটাই পোশাক নির্ভর। হঠাত করে পোশাক কে  ভাত খাওয়ানোর গল্পটা মনে পড়ে গেলো।

মেঘমুক্ত আকাশের তারারাও আমাদের সবার সাথে ছুটে চলছে। খুব গান শুনতে ইচ্ছা করছিল। তখনই এক ভিক্ষুক একটা গজল গাইতে গাইতে পাশ দিয়ে চলে গেলো।
আমি তার দিকে না ফিরে আকাশে টিম টিম করে জলতে থাকা একটা তারার দিকে তাকিয়ে রইলাম অপলক। ট্রেন ছুটে চলেছে আপন বেগে...............

রিফাত আহাম্মেদ
২০১৭

No comments:

Post a Comment

মাতাল নদীর রোদ ও পিংক ফ্লয়েড

এক লোক ট্রল করে ফেবু তে এই লোকের গাওয়া পিংক ফ্লয়েডের উইশ ইউ আর হিয়ার এর বাংলা ভার্শান দিলো ।  বাট আমার গান টা অসম্ভব ভালো লাগে । এক ধরণের ঘো...